ইসরাইলকে বলা হয় আরব বিশ্বের ক্যান্সার। ক্যান্সার একটি মারাত্মক ব্যাধি, মানুষকে আক্রমণ করলে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া উপায় থাকেনা। কিন্তু ক্যান্সার আক্রমণের প্রাক্কালে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যদি জীবনযাপন করা যায় তাহলে ক্যান্সার হতেও বাঁচা যায়।
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটে ক্যান্সারের ইস্যুর সাথে তুলনা সমীচীন বলে মনে করি। আরব-ইসরাইল সংকটে ক্যান্সার রোগের একটি সাদৃশ্য রয়েছে।
ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত। এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা তিনটি মহাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান হলো ফিলিস্তিন। আর ইহা ইহুদি ধর্ম ও খ্রিস্টধর্মের পীঠস্থান হিসেবেও পরিচিত। ভৌগলিক অবস্থান ও দুটি ধর্মের সূতিকাগার হওয়ায় ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডটি রয়েছে ধর্ম-সংস্কৃতি বাণিজ্য ও রাজনৈতিক দীর্ঘ এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথেই এই সুন্দর ভূখন্ডটি নানান জাতির দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। এদের মাঝে আছে কেনানীয়, প্রাচীন মিশরীয়, ইসরাঈলদের ইহুদি বংশ, পারস্য, প্রথম যুগের খিলাফত ইত্যাদি।
ফিলিস্তিন অঞ্চলটি পৃথিবীর প্রাচীন অঞ্চলগুলোর একটি যেখানে মানুষের বসবাস কৃষিনির্ভর জনসমষ্টি এবং সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ব্রোঞ্জ যুগের প্রথম ও মধ্যভাগের স্বাধীন কেনানীয় নগর রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল এখানেই। যা প্রাচীন মিশরীয়,মেসোপটেমিয়া, মাইনোয়ান কিট সিরিয়া গড়ে ওঠা সভ্যতা ধারা প্রভাবান্বিত।
ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন আলজিয়ার্স শহরে নির্বাসনে ঘোষিত একটি রাষ্ট্র আর তা ঘোষণা দেওয়া হয় ১৫ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পি .এল. ও) এবং প্যালেস্টাইন জাতীয় পরিষদ( পি. এন .সি) কর্তৃক একপাক্ষিক ভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের গোড়া-পত্তন হয়, আর বেলফোর ঘোষণা করেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস।
ইসরাইল ফিলিস্তিন সংকটের মধ্য প্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আমেরিকার সাথে আরব-বিশ্বের দ্বন্দ্বের অবসানের ক্ষেত্রে ইসরাইল ফিলিস্তিন সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এটি তৎকালীন বিশ্বের রাজনীতি-সচেতন সব মানুষই বোধহয় কমবেশি অবগত ছিলেন।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট আজ আরব-বিশ্বকে ছাপিয়ে মুসলিম বিশ্ব বনাম ইসরাইল মনোভাবে দ্বন্দ্ব হিসেবে রূপ নিয়েছে। ইসরাইল আরব যুদ্ধগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চার বার যুদ্ধে বিজয়ী ইসরাইল তাদের রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটাতেও সক্ষম হয়।
৬০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই মহাসংকট আরো বেশি গাঢ় হয়েছে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে ইসরাইলিদের প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, হত্যা রক্তপাত প্রতিদিনের রুটিন কর্মসূচি হিসেবেই যেন চালিয়ে যাচ্ছ ইসরায়েলিরা।
ফিলিস্তিন ও ইসরাইল সংকটের প্রধান খেলোয়াড়ের ভূমিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলের উপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম একমাত্র দেশটিই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ যুক্তরাষ্ট্র সবসময় নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে থাকে। ইজরায়েলের পক্ষে কাজ করে যাওয়া নির্ভীক এক সহযোগী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম এখন ওপেন সিক্রেট। ১৯৭৩ সালে তেল সঙ্কটের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে , ইসরাইল যুদ্ধের সময় বিমানযোগে ইসরাইলের জন্য অস্ত্র প্রেরণ করে তাদের উচিত জবাব দেয়ার জন্য সকল প্রকার ক্ষমতা কেড়ে নেয় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো। এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করা ইরাকের তেল সংক্রান্ত ফেডারেল আন্ডার সেক্রেটারি ফাদিল চালাবির কথা মতো তেলের দাম ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। তাদের এই কার্যক্রমকে আরো বেশি জোরদার করার লক্ষ্যে ওপেক গঠন করা হয়। এখানে তেল সংকটের কাহিনী বা ইতিহাস আনার কারন আরব বিশ্ব এক হওয়ার ফলে পুরো বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে তাদের শক্তি ও সমর্থন তাদের সাথে বেশ কিছু চুক্তিও কাজ করার ক্ষেত্রে ও তাদের নিজেদের দেশগুলোকে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সমর্থ হয়েছে।
লক্ষ্য করার মত বিষয়টি হচ্ছে, গত ১৯ই মার্চ ২০২৩ যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডানের মধ্যস্থতায় মিসরে বৈঠকে বসছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, এই বৈঠকে ফিলিস্তিনের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন যাতে নির্বিঘ্নে আল-আকসাতে নামাজ ও সকল ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করতে পারে সেটাই ছিল মুখ্য বিষয়। যদিও উভয় পক্ষ এই দাবিতে ঐক্যমত পোষণ করেছিল।সাম্প্রতিক বাস্তবতা তা যেন মিথ্যায় পরিণত করেছে। নিরীহ গাজাবাসীর ওপর তাদের প্রভূসুলভ আচরণ আরও অধিকতর বেড়ে গিয়েছে। হামাসের মুখপাত্র মুসা আবু মারজুক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইউরোপীয় ও আমেরিকান কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের দখলদারিত্ব নিয়ে বিবৃতি জারি করলেও ইসরায়েলকে তাদের আগ্রাসন বন্ধ করতে কোনও চাপ দেওয়ার ব্যবস্থা নেয় না।’
একটি যৌথ বিবৃতিতে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) জানায়, জোর করে শার্ম আল-শেখ সম্মেলনে যোগদান করছে পিএ। জনগণ এর পক্ষে নেই।
সাম্প্রতিক ইরান-সৌদিআরব সম্পর্কের উন্নতিতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদেশসমূহের প্রবল চাপের মুখে নেতানিয়াহু আল-আকসা হতে সকল অমুসলিম ও বিদেশী পর্যটক, ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রবেশ সীমিত করেছে। এই ছোট্ট পদক্ষেপ সেই ১৯৭৩ সালের ওপেকের কার্যকরী কর্মকান্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্য ও আরব দেশ গুলো তাদের নিজস্ব শক্তির সম্মিলিত মনঃসংযোগ স্থাপন করলেই ইসরাইল -ফিলিস্তিন সংকট দূরীভূত হবে। কেননা তা সাম্প্রতিক ইসরাইলের পিছু হঠার জ্বলন্ত নজির।
আরব বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রসমূহের বর্তমান যে অবস্থা তাতে যে কোনো রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি বলতে বাধ্য হবেন তা হলো, “ধরি মাছ না ছুঁই পানি”। কেননা আজকের বিশ্বে ইসরাইল খুবই শক্তিশালী একটি দেশ। অপরদিকে মুসলিম জাতি বিশ্বের কোন প্রান্তে কোন মুসলিম কোন প্রকার অপরাধ ছাড়া আক্রান্ত হলে তাদের অন্তরে ব্যথার বন্যা শুরু হওয়ার কথা কিন্তু তা যে আদৌ হচ্ছে না সবার জানা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশই মনে করেন মিশর, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ইরাক, সৌদি আরবসহ আরবদেশগুলো যারা ক্ষমতায় আছেন তারা নিজেদের গদি রক্ষার্থেই অতি বেশি ব্যস্ত।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে টেলিফোন লাইন চালু করার জন্য কাজ করেছে তার অগ্রগতি সম্পর্কে কথা বলতে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ফোনে আলাপ করেছেন ।এখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে আরব-বিশ্ব কি তাদের নিজ নিজ আসনে টিকিয়ে রাখতে তৎপর না ফিলিস্তিন সংকট দূর করতে তৎপর। ফিলিস্তিন তথা মুসলিম বিশ্বকে সুরক্ষিত করতে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিকভাবে উদারমনস্ক ও দায়িত্বশীল হওয়ার বিকল্প নেই।
লেখকঃ জে এম রফিকুল সরকার
শিক্ষার্থীঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
sarkarrafiqul42@gmail.com