৮ই মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে নারীদের প্রতি সম্মান জানাতে কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে শুরু করতে চাই “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃস্টি চির- কল্যানকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বিশ্বে যা কিছু এল পাপ -তাপ বেদনা অশ্রু বারি অর্ধেক তার আনিয়েছে নর, অর্ধেক তার নারী।
হুমায়ূন আজাদের ভাষায় কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, পুরুষতন্ত্র ক্রমশ একটি মানুষকে করে তোলে নারী,। পুরুষ সৃষ্টি করেছে নারী ধারণা, তৈরি করেছে তার সংজ্ঞা, নির্দেশ করেছে নারীর অবস্থান , তৈরি করেছে নৃশংস বিধিমালা, করে তুলেছে তাকে কাম সঙ্গী ও পরিচারিকা। পুরুষের চোখে নারী অসম্পূর্ণ মানুষ , এক আপেক্ষিক প্রাণী।
বিশ্ব নারী দিবস প্রতিবছর ৮ই মার্চে পালন করা হয়। এই দিনটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে একটি। এই দিনটি নারীদের সমানতা, অধিকার এবং পুরুষদের সাথে বরাবরের সম্মান ও প্রেম জ্ঞাপন করার দিন।
মনুসংহিতা তো বলেই দিয়েছে “পিতা রক্ষতি কৌমারে , ভর্তা রক্ষতি যৌবনে , রক্ষন্তি স্হবিরে পুত্র, ন স্ত্রী সাতন্ত্র মহতী”
অর্থাৎ কুমারী কালে পিতা , যৌবনে স্বামী ও বৃদ্ধকালে সন্তান নারীকে রক্ষা করবে। তার কোন স্বাধীন সত্তা নেই । এভাবেই নারীকে কখনো ধর্মের কখনো পুরুষতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার স্বার্থে মানুষ না হয়ে কেবলই নারী হয়ে থাকতে হয়েছে। কিন্তু সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না । কালেরচক্র ঘুরে ঘুরে নারী তার সত্তা ও সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে থাকে।
নারী শুধু সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্র নয়, সে ও মানুষ , তার ও যোগ্যতা ও দক্ষতা আছে ঠিক পুরুষ সম। শুধুই দৈহিক গঠনের পার্থক্য এই যা, কিন্তু হাজার হাজার বছরের ভ্রান্ত পুরুষতান্ত্রিক ধারণাকে বদলে দিয়ে নারী সমযোগ্যতা প্রমাণ করে স্বীয় স্থান জানান দিতে থাকে সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। পুরুষতন্ত্রের বিপত্তিটাও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু নারী তো অদম্য সে তো সৃষ্টি করতে জানে। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় সে তার যোগ্যতা ও দক্ষতার ছাপ রাখতে থাকে। অনেক খেসারত দিতে হয় আর কি।
সেই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সমান কাজ করেও মজুরি বৈষম্য কর্ম ঘন্টা , কাজের অমানবিক পরিবেশ এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমে সুতার কারখানার নারী শ্রমিকরা সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর দমন পীড়নের শিকার হয়। তাইতো জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়।
ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ১৭ টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দেয়।
১৯১১ সাল থেকে ৮ মার্চকে নারীদের সম অধিকার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে দিবসটি পালিত হতে থাকে। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করে বিভিন্ন দেশকে দিবসটি পালনের আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকেই সারা পৃথিবীতে দিবসটি পালিত হতে থাকে।
হাটি হাটি পা পা করে চলতে থাকে নারীদের অগ্রযাত্রা । শিক্ষা ,কর্ম , সমাজ , জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে থাকে। মহাকাশ গবেষণা , বিমান চালানো , ঘরে বাইরে সকল কর্মে এমন কি দেশের আভ্যন্তরিন শৃঙ্খলা ও বহি শত্রুর আক্রমণ রক্ষার ক্ষেত্রেও তারা পুরুষের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে নেই।দেশ পরিচালনা ও আন্তজাতিক পরিমণ্ডলে তাদের সরব পদচারনা। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এটা মেনে নিতে পারছে না। তাই তো রাস্তাঘাটে ইভটিজিং , কর্মস্থলে যৌন হয়রানি , সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা যেন তাদের পিছু ছাড়ছে না। নারী মা , নারী শিক্ষায় পুরুষের সমান পারদর্শী , কোন কিছুতে তার যেন ক্লান্তি নেই। কর্মক্ষেত্রে ও সমান তালে এগিয়ে চলছে নারী।কোথাও যেন কমতি নেই , কমতি শুধু মূল্যায়নের ও সম্মানের। তাই বিশেষ এই দিনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে শুধু জানান দিতে চাই নারী অবলা নয় তাকে অসম্মান করার কারো মানবিক অধিকার নেই।নারীরাও মানুষ শুধু মা নয়। মানুষ যেমন দু পা ছাড়া দ্রুত দৌড়াতে পারে না তেমনি সমাজের অর্ধেক নারীকে উপেক্ষা বা অবমূল্যায়ন করে সমাজ , রাষ্ট্র বাঁচতে বা দ্রুত এগোতে পারবেনা। আসুন আমরা সবাই সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নারী জাতিকে যথাযত সম্মান ও মানবিক মযার্দা দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই।
লেখক: অধ্যাপক ড. দীপিকা রাণী সরকার
প্রভোস্ট, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

