২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩এ মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পূর্ণ হবে। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। আগামী মঙ্গলবার শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে রফিক-জব্বার, সালাম-বরকতদের ত্যাগে পাওয়া এই বাংলা ভাষা নিয়ে এ প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনা তুলে ধরেছেন আব্দুল্লাহ আল নোমান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেখ জামাল উদ্দিন বলেন,”ভাষা একটি জাতির পরিচয় বহন করে। পৃথিবীর একমাত্র জাতি আমরা যারা বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত রাজপথে বিলিয়ে দিয়েছি। ফলশ্রুতিতে ২১শে ফেব্রুয়ারি হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যে ভাষার জন্য এতো আত্মত্যাগ, এতো আন্দোলন, এতো দৌরাত্ম্য সেই ভাষাকেই আমরা আজ অবহেলা করছি। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা মাতৃভাষার চেতনায় উজ্জীবিত হই। বাকি এগারো মাস ঘুম পাড়িয়ে রাখি মাতৃভাষার চেতনাকে। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভাষা শহিদদের স্মরণ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মিনারে ফুল প্রদান আর ছবি তোলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রদানের মধ্য দিয়ে ভাষার প্রতি আমাদের চেতনা দেখাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে এ পর্যন্ত ৭১ টি বছর পেরিয়ে গেল। আজ এত বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা-অবহেলা করা হচ্ছে বারবার। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সব জায়গায় বাংলাকে হেয় করা হচ্ছে। আজকালকার দিনের কিছু মা-বাবারা গর্ববোধ করেন যে তাদের ছেলে-মেয়েরা বাংলা কথা বলতে পারেন না। শিশুকাল থেকেই তাদের ইংরেজি বিলাসী তৈরি করে। ‘মা’ আর ‘বাবার’ জায়গাটা কবেই ‘মাম্মি’ আর ‘ড্যাডি’ নিয়ে নিয়েছে। আরও একটা বিষয় এখানে বলতে চাই, কেউ যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলায় বার্তা পাঠায় সেটা কিন্তু বাংলাতে লেখা হয় না। ইংরেজি অক্ষরে বাংলা কথা গুলো লেখা হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ‘বাংলিশ’ নামক এক আশ্চর্য জগাখিচুড়ি ভাষা। এভাবে প্রাণের বাংলা ভাষাকে অপমান করা মোটেই সমীচীন নয়। সকলের উচিত বাংলিশকে পুরোপুরি বর্জন করা এবং শহিদদের সম্মানে, মাতৃভাষার সম্মানে সর্বাবস্থায় বাংলা ভাষার ব্যবহার করা।
বাংলা হোক আমাদের হৃদয়ের সুর, আমাদের মুখে প্রাণ পাক চির অমলিন এই প্রাণের মাতৃভাষা।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুরাইয়া ইয়াসমিন তিশা বলেন, “বাঙালি প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য নিজের রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজকাল আধুনিকতার বেড়াজালে বিভিন্ন বিদেশি শব্দের মিশ্রণে বাংলা ভাষা তার মাধুর্য হারিয়েছে। কথায় কথায় বাংলা ইংরেজির মিশ্রণকে তথাকথিত স্মার্টনেস বলে গণ্য করা হলেও বাংলা ভাষা তার মর্যাদা হারাচ্ছে।বার বার আমাদের ভাষা আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আদৌ কি আমরা ভাষার মান রাখতে পেরেছি?”
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিসমত রেজা বলেন, “ভাষা শব্দটি অতি ছোট। কিন্তু আমরা বাঙালিদের কাছে এই শব্দের গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার মাইল দূরত্বের দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্ত্বাকে নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। আর তখন থেকেই সূচনা হয় মাতৃভাষা নিয়ে আন্দোলন। আর এই আন্দোলনই ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রথম ধাপ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আমাদের ভাইদের নিজেদের মূল্যবান জীবন দিতে হয়েছে। আমরা হয়তো তাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করতে পারবো না কিন্তু অবদানকে চিরস্মরণীয় করার জন্য সচেষ্ট হতে পারি। এই মাসে আমাদের অঙ্গীকার করা উচিত যে আমরা আমাদের প্রিয় ভাষাকে সম্মান দিব। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও ব্যক্তি হিসাবে একটি সুসংবদ্ধ সমাজ গঠনে ভাষার মূল্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমরা আমাদের ভাষাকে উন্নয়ন করতে হবে এবং ভাষার সংরক্ষণ এবং বিস্তারে যোগদান করতে হবে এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রাখতে চেষ্টা করব। আমরা আমাদের ভাষা বিষয়ক জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠানগুলির সুদৃঢ় ও সুসংবদ্ধ মৌলিক অধিকারকে সমর্থন করব।“
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান বলেন, “২১শে ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের মানে বাঙালিদের জন্য একটি বিশেষ দিন। এই দিনে আমরা আমাদের প্রিয় ভাষা বাংলা কে আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে অর্জন করতে পেরেছি। আর এই বিশাল অর্জনের পিছনে ছিলো বহু বাঙালির প্রাণ বিসর্জন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত সহ আরো অনেকে। এই দিনটি বাংলাদেশে শহিদ দিবস হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এখনকার সময় আমাদের এই ভাষা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাষা দিবস পালন করা জাস্ট একটা শো অফ ছাড়া কিছুই না। মানুষ প্রতিনিয়ত নিজের ভাষাকে পরিবর্তন করে যাচ্ছে। আজ কাল আমরা বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজিকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। অনেকে তো এটা মনে করে যে বাংলায় কথা বললে নাকি নিজের স্ট্যাটাস নেমে যায় স্মার্ট হওয়া যায় না নাকি। যারা অল্প শিক্ষিত তারা বাংলায় কথা বলে আর মডার্ন যুগের মানুষ ইংরেজি তে কথা বলে। কিন্তু এই ভাষা নিয়ে আমাদের যা ইতিহাস রয়েছে সেটা কেউ চিন্তা এ করে না। এভাবেই আমাদের বাংলা ভাষাকে ধীরে ধীরে আধুনিকতার মাঝে হারিয়ে ফেলেছি। আমরা আমাদের নিজের ভাষায় অন্যের সাথে কথা বলতে লজ্জা পাই। কথাকে মডিফাই করে ইংরেজি এবং বাংলা মিশ্রিত এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলি। একজন বাঙালি হিসেবে যা খুবই লজ্জাজনক।”
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইকরামুল হাসান তূর্য বলেন, “বাংলা ভাষা এমন একটা ভাষা যেটার জন্য মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে, তাই বাংলা ভাষা আমাদের জন্য খুবই আবেগের। এই ভাষার জন্য যারা শহীদ হয়েছিলেন, এই ভাষার মাসে তাদের সকলকে শ্রদ্ধা জানাই। তারা চির অমর।”
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আল শাহরিয়ার আসিফ বলেন, “ভাষা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। বায়ান্নতে রফিক শফিকের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া ভাষা আজ ভালো নেই। পৃথিবীর মাটি পানি বাতাসের মত ভাষাও এখন দূষিত। ভাষা তার প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন না। ভাষা যোগ্য ব্যবহার হচ্ছে না।”
চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী কাজী শাফিন বলেন, “ভাষার মাসে না মাথায় মাঝেমধ্য এমনিতেই চিন্তা আসে যে আসলে আমরা কি বাঙালি হতে পেরেছি? অনেকেই তো বাঙালি বললে রাগও করে। কাউকে দুই মিনিট শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে বলা গেলে দেখা যাবে ৫-১০ টা ইংরেজি শব্দ চলে এসেছে। আসল কথা হলো,আগামী প্রজন্মকে সঠিক নির্দেশনা দিতে হবে নয়তো বাংলা ভাষার এভাবে বিকৃতি ঘটতে থাকবে।”
নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ফেরদৌস আলম প্রিন্স বলেন, “যেই বাংলা ভাষা লাখো শহিদের ত্যাগ এর বিনিময়ে পেয়েছি সেই বাংলা ভাষা এখনও যেন কাগজে কলমেই রয়ে গেল। যেই ভাষার অর্জন আমাদের এই বাংলাদেশ , আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঙালি হয়েও যেন আমরা তা ভুলতে চলেছি।”
প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম শরীফ বলেন, “একটি দেশের ভাষা একটি দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। নিজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করার মাঝে যে মুক্তি মেলে সেটি একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে।তাই, এই ভাষার মাসে একজন তরুণ প্রজন্মের সারথি হিসেবে চাওয়া সকল অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাকে শ্রদ্ধার মাধ্যমে আমরা যেন সকল মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই।”
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিহাদুজ্জামান জিসান বলেন, “জাতি হিসেবে বাঙালির সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন মাতৃভাষা বাংলা। পৃথিবীর বুকে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। কিন্তু এতো কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া এই ভাষাকে আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছি না। বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণে বাংলা ভাষা তার শ্রুতিমাধুর্য হারাতে বসেছে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।”