amadermuktokantho
চট্টগ্রামমঙ্গলবার , ১৪ জানুয়ারি ২০২৫
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পৌষ সংক্রান্তি মেলা শেকড়ের টানে ঐতিহ্যের উজ্জ্বল প্রদীপ

সাফিউল ইসলাম রকি
জানুয়ারি ১৪, ২০২৫ ১২:০৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

পৌষ সংক্রান্তি, বাঙালি সংস্কৃতির এক অমূল্য অংশ, যা সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশের দিন উদ্‌যাপন করা হয়। এই উৎসব শীতের বিদায় ও নতুন ঋতুর সূচনার প্রতীক। পৌষ সংক্রান্তির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো মেলা। গ্রামবাংলার মাটিতে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এই মেলাগুলো শুধু বিনোদনের স্থান নয়, বরং গ্রামীণ জীবনের এক সুন্দর প্রতিচ্ছবি।

পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় অংশ নেন অসংখ্য মানুষ। শীতের স্নিগ্ধ সকালে গ্রাম কিংবা শহরের খোলা মাঠে শুরু হয় মেলা। এখানে থাকে নানা পণ্যের দোকান, হস্তশিল্প, মাটির তৈজসপত্র, বাঁশের তৈরির সামগ্রী, পিঠা-পুলির দোকান, এবং গ্রামীণ শিল্পকলার প্রদর্শনী।

বাচ্চাদের জন্য থাকে খেলনার স্টল, নাগরদোলা, ও সার্কাসের আয়োজন। সন্ধ্যা হলে মেলার পরিবেশ আলোকসজ্জায় হয়ে ওঠে আরও মনোমুগ্ধকর। স্থানীয় শিল্পীদের গান, জারি-সারি, কবিগান, নাটক—সব মিলিয়ে এক প্রাণবন্ত আবহ সৃষ্টি হয়।

পৌষ সংক্রান্তি মেলা মানেই পিঠা-পুলি আর মিষ্টির ছড়াছড়ি। পাটিসাপটা, দুধপুলি, ভাপা পিঠা, নারকেল নাড়ু, মোয়া—এসব খাবার মেলার বিশেষ আকর্ষণ। বিশেষ করে গ্রামের মা-দিদিমারা পিঠা বানিয়ে নিয়ে আসেন এবং মেলায় বিক্রি করেন। শহরবাসীর কাছে এটি হয়ে ওঠে গ্রামীণ খাবারের স্বাদ নেওয়ার এক বিশেষ সুযোগ।

এই মেলা কেবল কেনাকাটার জায়গা নয়, এটি একটি মিলনমেলা। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মেলায় এসে একত্রিত হন। বড়রা স্মৃতিচারণ করেন, ছোটরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। প্রবাসীরাও এই সময় গ্রামে ফিরে আসেন, কারণ এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আবেগ আর শেকড়ের টান।

যদিও পৌষ সংক্রান্তি মেলা এখনো অনেক জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়, তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এর চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। প্লাস্টিক পণ্যের আধিক্য, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং গ্রামীণ ঐতিহ্যের স্থান দখল করে নিয়েছে অনেক আধুনিক উপকরণ। তবু লোকসংস্কৃতির এই অমূল্য ঐতিহ্য ধরে রাখতে মানুষের প্রচেষ্টা অব্যাহত।

পৌষ সংক্রান্তি মেলা কেবল একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রতীক। এই মেলার মাধ্যমে মানুষ শিখতে পারে ঐক্য, শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা, এবং সংস্কৃতির মাধুর্য। যুগ বদলালেও, মেলার আবেদন যেন অমলিন থাকে, এই কামনা নিয়ে এই মেলা চলুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

আমি মনে করি পৌষ সংক্রান্তি মেলা বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমাদের শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা এবং ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রকাশ করে। এই মেলাগুলো কেবল আনন্দ ও বিনোদনের জায়গা নয়, এটি আমাদের লোকজীবনের প্রতিচ্ছবি। শহুরে জীবনের যান্ত্রিকতা ভুলিয়ে দেয়ার পাশাপাশি এই মেলা আমাদের শিখিয়ে দেয় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব।

তবে, আধুনিকতার ছোঁয়া যেমন মেলাকে সময়োপযোগী করে তুলেছে, তেমনই কোথাও কোথাও এর গ্রামীণ রূপ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ও প্রাচীন ঐতিহ্যের অবহেলা অনেককে চিন্তিত করছে। এই মেলাগুলোর মাধ্যমে আমাদের উচিত গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা।

পৌষ সংক্রান্তি মেলা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ঐতিহ্য ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব। তাই মেলার আয়োজনের পাশাপাশি ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সচেতন উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

আজগর আলী বলেন এই মেলা আমাদের শেকড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকার এক বড় সুযোগ। যখন আমরা ছোট ছিলাম, তখন এই মেলা ছিল পুরো গ্রামের উৎসব। সবাই মিলে পিঠা বানানো, গরুর গাড়িতে চড়ে মেলায় যাওয়া, আর সন্ধ্যার আলোকসজ্জায় মুগ্ধ হওয়া—সবকিছুই ছিল এক অন্যরকম আনন্দ।

আজকাল মেলার চেহারা অনেক বদলে গেছে। আগে মাটির খেলনা, বাঁশের পণ্য, আর হস্তশিল্পের কদর ছিল। এখন প্লাস্টিক আর আধুনিক জিনিসে ভরে যাচ্ছে। কিন্তু মন তো সেই পুরোনো দিনগুলোই খোঁজে।

এই মেলা শুধু আনন্দের জায়গা নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। তরুণ প্রজন্মকে বলব, এই ঐতিহ্য যেন তারা ধরে রাখে। শিকড় ভুলে গেলে মানুষ নিজের অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলে। আমি চাই এই মেলা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এভাবেই চলতে থাকুক।

সৌদি আরব প্রবাসী আব্দুল মতিন মৃধা বলেন প্রতিবারই পৌষ সংক্রান্তি মেলার সময় দেশে ফেরার চেষ্টা করি, কারণ এই মেলা আমাকে আমার শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। দেশের বাইরে থাকতে থাকতে এই ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির প্রতি টান আরও বেড়েছে।

ছোটবেলায় বাবা-মায়ের হাত ধরে এই মেলায় আসতাম। মাটির খেলনা, নাগরদোলা, আর পিঠার গন্ধে পুরো মেলা যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। আজও সেই মেলায় পা দিলে মনে হয়, শৈশব ফিরে পেলাম।

বিদেশে অনেক আরাম-সুবিধা থাকলেও এই মেলার মতো আত্মার তৃপ্তি সেখানে নেই। আমি চাই আমাদের এই ঐতিহ্য আগামীর প্রজন্মও জানুক, অনুভব করুক। আমাদের সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখার জন্য এই মেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যতদিন পারি, এই মেলার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চাই।”

কানাডা প্রবাসী শিল্পপতি সাদিকুল ইসলাম সোহাগ বলেন আমি দীর্ঘদিন ধরে কানাডায় থাকি, কিন্তু হৃদয়ের টান আমাকে বারবার নিজের শেকড়ে ফিরিয়ে আনে। পৌষ সংক্রান্তি মেলা আমার শৈশবের এক অনন্য স্মৃতি। গ্রামের মেলার সেই প্রাণচাঞ্চল্য, পিঠার গন্ধ, আর মানুষের উৎসাহ আজও আমাকে মুগ্ধ করে।

আমি বিশ্বাস করি, এই মেলা শুধু বিনোদন নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং গ্রামীণ জীবনের পরিচয়। কানাডায় থেকেও আমি চেষ্টা করি, আমাদের ঐতিহ্য যেন নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে। আমাদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সচেতন উদ্যোগ।

আমার ইচ্ছা, মেলার আয়োজনে আমি কিছু অবদান রাখতে পারি। গ্রামের মানুষ এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হবে না। এমন মেলা আমাদের শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয় এবং আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখে।”

আমেরিকান প্রবাসী আব্দুল হালিম রবি বলেন

“বিদেশে অনেক কিছু পেয়েছি, কিন্তু মাটির টান আর গ্রামীণ ঐতিহ্যের যে শান্তি, তা কোথাও পাইনি। পৌষ সংক্রান্তি মেলা আমার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছোটবেলায় এই মেলায় যাওয়ার স্মৃতি আজও আমার মনে টাটকা। পিঠার গন্ধ, নাগরদোলার ঘূর্ণন, আর মানুষের মুখের আনন্দ—এসব কিছুর মধ্যেই এক অন্য রকম আবেগ লুকিয়ে থাকে।

আমেরিকায় থাকতে শিকড়ের টান আরও বেশি অনুভব করি। এই মেলা আমাদের শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিদেশে আমাদের সন্তানদের এই ঐতিহ্যের কথা জানাতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, এমন মেলাই আমাদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার বড় মাধ্যম।

যতবার দেশে আসি, চেষ্টা করি এই মেলায় অংশ নিতে। আমি চাই, এই ঐতিহ্য শুধু গ্রামে নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক। আমাদের সংস্কৃতির প্রতি এই টান কখনো যেন হারিয়ে না যায়।”

এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি। তাই কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।