ছাত্রজনতার আন্দোলন ও ত্যাগের মাধ্যমে আবারও দেশ স্বৈরাচারী শাসকের হাতে থেকে মুক্তি লাভ করেছে। তাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নতুনভাবে দেশের সংস্কারের সাথে জ্ঞানচর্চার আতুড়ঘর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ ক্যাম্পাসেরও সংস্কার চায়। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন আল মাসুম হোসেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যাবস্হা শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটাক
আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ক্রমবিকাশে মানুষকে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করতে হচ্ছে নানা ধরণের শিক্ষা। যুগের পালাবদলে শিক্ষা ব্যবস্থার বহুমাত্রিক পরিবর্তন ও পরিমার্জন হয়েছে। যা বর্তমানেও চলমান। কোনো বিষয়ের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করতে একটি ভালো পাঠদান ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। একটি ভালো পাঠদান ব্যবস্থা মূলত নির্ভর করে এর উপাদান, কারিকুলাম বা সিলেবাস, শিক্ষাদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও সমাজে শিক্ষার্থীর অবদান এর উপর। সত্যিকার অর্থে একটি ফলপ্রসূ পাঠদান ব্যবস্থার কন্সেপ্ট বেশ জটিল। তবে সার্বিক লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্রের মূল্যবান সম্পদে পরিণত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে কারিকুলাম ও সিলেবাস বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি এমনভাবে সাজানো হতে হবে যাতে একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে উদ্ভাবনী কাজে সহজেই নিজের অবদান রাখতে পারে এবং সমাজের সংকট নিরসন করতে পারে। এর গুণগত মান হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। পাঠ্যবই এর পাশাপাশি গবেষণা পত্র, কেইস স্টাডিজ, ইত্যাদি পড়া এবং ব্যাবহারিক জ্ঞানার্জন এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজেক্ট, ইন্টার্নশিপ, গবেষণার কাজে নিয়োজিত রাখা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি কার্যকরী পাঠদান পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত যা শিক্ষার্থীদের গদবাধা মুখস্থকরণ এর উর্ধ্বে তাদের learning style এর উপর নির্ভর করবে এবং সৃজনশীলতা ও মেধা বিকাশ ঘটবে। এতে বিভিন্ন ধাপ থাকতে পারে যেমন: লেকচার প্রদান, মেন্টরিং, ব্যবহারিক ক্লাস, রিসার্চ প্রজেক্ট এসিস্টেন্টশিপ ইত্যাদি। এছাড়া তাদের কো-কারিকুলার এ উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ক্লাবগুলোতে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। ইনকোর্স, সেমিস্টার বা ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কারও এখন সময়ের দাবি। উন্নত দেশের মতো continuous assessment, essays, projects, survey participation- এর মতো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন করা উচিত। একটি সুন্দর পাঠদান ব্যবস্থার ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তি জীবনে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে তাদের মেধার সাক্ষর রাখতে পারে।
রাবিয়া আকতার, শিক্ষার্থী
ফার্মেসি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস চাই
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জ্ঞানচর্চার অন্যতম আঁতুড়ঘর।যেখানে একজন শিক্ষার্থী সমাজতন্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, বিশ্ব রাজনীতি সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান দিক নিয়ে সম্যক ধারনা অর্জন করতে পারে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ গুলোতে ছাত্র রাজনীতি নামক যেসব সংগঠনে অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা বিগত কয়েক দশকে শিক্ষার পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্ররাজনীতির আওতাধীন। হলের সিট থেকে শুরু করে নানান বেআইনী সুযোগ সুবিধা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীরাই পান। অনেক শিক্ষার্থীকে আবার জোরপূর্বক ক্লাসের মাঝখান থেকে কিংবা মিডটার্মের আগের দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি, মিটিং, মিছিল গুলোতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। অবাধ্য হয়ে কেউ এগুলোতে অনুপস্থিত থাকলে হলের টর্চারসেল-গেস্টরুম গুলোতে সমুখীন হতে হয় বিভিন্ন শারিরীক ও মানষিক নির্যাতনের। রাজনৈতিক ছাত্রনেতাদের অমানবিক অত্যাচার ও সহিংসতায় প্রান হারান অনেক নিরপরাধ মেধাবী সন্তান। যদিও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এখন দেখবার বিষয় কতটুকু আমল হয়। আবার মহান পেশায় নিয়োজিত শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দুই মাস বন্ধ ছিলো যার ফলাফল ভোগ করছি আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক সমিতির নির্বাচন, ডিন, সিনেট ও সিন্ডকেট নির্বাচনে এ দলাদলি স্পষ্ট ফুটে উঠে। দলাদলি আর রাজনৈতিক খুঁটির জোরে শিক্ষকদের পরস্পরের মধ্যে সমস্যা লেগেই থাকে ও বলির পাঠা হই আমি, আমরা, শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকরা ভুলেই গেছেন তারা দেশ ও জাতি গড়ার কারিগর। তাই শিক্ষকদের কাছে অনুরোধ থাকবে লাল দল, নীল দল, সাদা দল ভুলে শিক্ষকদের প্রধান কাজ পাঠদান, গবেষণায় মনোনিবেশ করতে।দলীয় কার্যক্রম প্রদর্শনের চেয়ে দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে নজর দিতে হবে।দেশের সর্বস্তরের জনগণের ঘাম ঝরা পরিশ্রমের টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে।কোনো দলের নয়, দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে।
ওমর ফারুক ইমন, শিক্ষার্থী
গণিত বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
জ্ঞানচর্চায় হলগুলোকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের হল ৩ টি ও মেয়েদের ২ টিসহ মোট ৫ টি হল রয়েছে।এই হলের শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়, এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খাবারের মানে সমস্যা, পানির সমস্যা,রাজনৈতিক দলের চাপ,রুমের লাইট, ফ্যান নষ্ট হওয়ার মতো সমস্যা । তবে এগুলোর মধ্যে খাবারের ও পানির সমস্যা অন্যতম।খাবারের মান উন্নত না হওয়ার কারণে অনেকে সেটা খেতে পারে না বা খেলেও অসুস্থ হয়ে যায়।অন্যদিকে,অনেক বেসিনে পানি আসে না।মাঝেমধ্যে খাবার পানির লাইনেও পানি আসে না।ছেলেদের হলের ডাইনিংয়ের খাবারের মান মেয়েদের হলের চেয়ে ভাল হলেও হলের রুম,বেসিন ও ওয়াশরুম গুলো একটু বেশি অপরিচ্ছন্ন থাকে সাথে রাজনৈতিক চাপ তো আছেই। বর্তমানে হলে কারো রুমের লাইট,ফ্যান নষ্ট হলে নিজের টাকায় ঠিক করতে হয়।ওয়াশরুমের লাইট নষ্ট হলে বা বেসিন নষ্ট হলে, হল কর্তৃপক্ষকে বারবার জানানোর পরেও দ্রুত সাড়া পাওয়া যায়না।যা হল কর্তৃপক্ষের অবহেলার নামান্তর। আমরা দ্বিতীয় বারের মতো দেশকে স্বাধীন করেছি।সুতরাং এই স্বাধীন বাংলাদেশে আমি চাইব যে,আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি পড়াশোনা করতে আর হল আমাদের বাসস্থান।সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও হল কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষার্থীদের উপরিউক্ত সমস্যা থেকে বাইরে রাখা। পড়াশোনার চিন্তা ছাড়া পারিপার্শ্বিক কোনো চিন্তা যাতে আমাদেরকে করতে না হয় সেদিকে কর্তৃপক্ষের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের এমন পরিবেশ চাই, যেখানে শিক্ষার্থীরা কোন বাধা ছাড়াই নির্বিঘ্নে জ্ঞানচর্চায় নিজেদের আত্ননিয়োগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারে।
সানজিদা ইয়াসমিন লিজা,শিক্ষার্থী
আইন বিভাগ,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন হবে সচ্ছ ও শিক্ষার্থী বান্ধব প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর খাবার। তাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান উন্নত করতে হবে এবং রান্নাঘর সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের হোটেল গুলোতে খাবারের অতিরিক্ত দামের কারণে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী কিনে খেতে না পারাই অপুষ্টিতে ভুগে রোগে আক্রান্ত হয়। তাই আশেপাশের হোটেল গুলোতে খাবারের দাম কমাতে হবে। মেডিকেলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি,ওষুধ ও সার্বক্ষণিক ডাক্তারের সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ডিপার্টমেন্ট ভিত্তিক ছেলে ও মেয়েদের নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেউ উগ্রবাদ ছড়িয়ে যাতে অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশে শান্তি বিনষ্ট করতে না পারে। সেই জন্য শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও কেউ যাতে কারো ধর্মের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করতে না পারে সেই জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কতৃক কঠোর আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ বাস না থাকাই শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তাই বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে সপ্তাহে সাত দিন বাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার একঘেয়েমি দূর করার জন্য সারাবছর খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বহিরাগত কেউ যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশ করে অপকর্ম চালাতে না পারে সেই দিকে কঠোর দৃষ্টি ও নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা ওয়াশ রুম ও তা পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইয়াছিন আরাফাত,শিক্ষার্থী
অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়